বদলে যাচ্ছে বাংলা সংগীত
বদলে যাচ্ছে বাংলা সংগীত
বিনোদন updated 2 years ago

বদলে যাচ্ছে বাংলা সংগীত

বদলে যাচ্ছে বাংলা সংগীত

এই সময় দেশের দুটি গানের প্ল্যাটফরম রয়েছে তুমুল আলোচনায়। একটি হচ্ছে ‘কোক স্টুডিও বাংলা’, অন্যটি ‘আইপিডিসি আমাদের গান’। পুরনো গানগুলোর সঙ্গে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের এক দারুণ সংমিশ্রণ ঘটে কোক স্টুডিও বাংলার প্ল্যাটফরমে। আর মাটি ও মানুষের গান নিয়ে একটি ভিন্ন মাত্রার সংগীতায়োজন আইপিডিসি ‘আমাদের গান’। এই দুই ভিন্ন আয়োজন নিয়ে লিখেছেন - পান্থ আফজাল

২০২০ সাল থেকে সম্প্রচারিত হচ্ছে ‘আইপিডিসি আমাদের গান’ অনুষ্ঠানটি। এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশের লোকজ সংগীতকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই হলো অন্যতম উদ্দেশ্য। দেশের জনপ্রিয় কিছু ফোক গান নতুন আঙ্গিকে রেকর্ড করে পরিবেশন করছেন উদীয়মান শিল্পীরা। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী পার্থ বড়ুয়া। দেশের মাটি ও মানুষের প্রাণের গান নিয়েই এ ভিন্ন মাত্রার সংগীতায়োজন। এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পেরে নিজের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সংগীতশিল্পী পার্থ বড়ুয়া। তিনি দেশের নিজস্ব সংগীতের গভীরতা এবং বৈচিত্র্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাবেন বলে জানান। এদিকে এই আয়োজনের প্রথম গান ছিল শিল্পী শিউলি সরকারের কণ্ঠে শাহ আবদুল করিমের ‘সখী তোরা প্রেম করিও না’। গানটি প্রকাশ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দারুণ সাড়া পড়ে। তবে পার্থ বড়ুয়ার সংগীতায়োজনে চঞ্চল চৌধুরী ও মেহের আফরোজ শাওনের একসঙ্গে গাওয়া জনপ্রিয় লোকজ গান ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ দুই বাংলায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর ফেসবুক পেজে গানটির মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করলে প্রচুর শেয়ার হয়। রাধা ও কৃষ্ণের প্রথম দর্শনের অনুভূতি নিয়ে রচিত এই গানটির প্রশংসা যখন তুঙ্গে তখন সরলপুর ব্যান্ড এই গানটি নিজের বলে দাবি করে। শুরু হয় বিতর্ক। তবে মৈমনসিংহ গীতিকার জনপ্রিয় এই গানটির বেশ কয়েকটি লাইন চুরি করে নিজেদের তৈরি করা ‘যুবতী রাধে’ গানের সঙ্গে যুক্ত করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরলপুর ব্যান্ডের কপিরাইট স্বত্ব বাতিল করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস। শাওন-চঞ্চলের গাওয়া পরের গান ‘নেশা লাগিল রে’ গানটিও তুমুল জনপ্রিয় হয়। এরপর একে একে ‘আইপিডিসি আমাদের গান’ থেকে প্রকাশ হয় বিউটির ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, লায়লার ‘তিন পাগলের হলো মেলা’, এফ মাইনরের ‘তুরু রুতু তুরু রু’, গামছা পলাশের ‘কলকল ছলছল’, হৈমন্তির ‘চানমুখে মধুর হাসি’, গামছা পলাশ ও অংকনের ‘বেতের আড়া’, কালা মিয়ার ‘বসন্ত বাতাসে’, সন্দিপন-অরিনের ‘নাইয়র নিবা নিবা গরি’, সোহাগের ‘তোমার বুকের সিংহাসনে’, নাদিয়া ডোরার ‘প্রাণ সখিরে’, চঞ্চল-শাওনের ‘নেশা লাগিল রে’, লায়লার ‘জাত গেল’, জলের গানের ‘ইস্কুল খুইলাছে’, অনিমেষ রায়ের ‘মন ভালা না’, নবনিতা চৌধুরীর ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’, শফি মন্ডলের ‘মন আমার দেহঘড়ি’, ফজলুর রহমান বাবুর ‘দোল দোল দুলুনি’, বিউটির ‘সহজ মানুষ’, অংকন-কামরুজ্জামান রাব্বীর ‘ও বাবু সেলাম বারে বার’, শিউলি সরকারের ‘লোকে বলে’, জলের গানের ‘সুয়া উড়িল’ ও ‘পরের জায়গা পরের জমি’, জাকির হোসেন লিমনের ‘পদ্মার ঢেউ রে’ ও কুমার বিশ্বজিতের ‘নয়া বাড়ি লইয়া রে বাইদ্যা’। মৈমনসিংহ গীতিকার গান ‘নয়া বাড়ি লইয়া রে বাইদ্যা’ গানটি নিয়ে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘নয়া বাড়ি লইয়ারে বাইদ্যা’ গানটি নিয়ে শ্রোতাদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পাচ্ছি। যেখানে অডিও অ্যালবাম নেই সেই সময়ে এসে এটি সত্যি অন্যরকম একটি ব্যাপার। গানটার মধ্যে একটি লাইন আছে, ‘তোমার গলার হার গো’। এই কথাটা খুব পছন্দ করেছে শ্রোতারা। আমার স্ত্রীও এই এক লাইন গুনগুন করছে। গানটি পার্থ বড়ুয়ার কারণেই গাওয়া হয়েছে। এই গানটি অনেক বছর আগে কলকাতার ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ড তাদের কণ্ঠে তুলেছিল। কতদিন আগে এটা গেয়েছে তারা! এটা ভাবা যায়? বাংলাদেশের লায়লা নামে একজন কণ্ঠশিল্পী গানটা আগে গেয়েছে। মাটির গান, শিকড়ের গান সবসময়ই মানুষ পছন্দ করে। এটা আবারও প্রমাণ পেলাম।’ এদিকে ‘জলের গান’র ভোকাল রাহুল আনন্দ বলেন, ‘খুব আনন্দ নিয়ে গান করেছি আমরা। কথা ছিল একটি গান করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কয়েকটি গান করেছি। সঙ্গে যোগ হয়েছে নাটকীয়তা। গানের পাশাপাশি জলের গানের নিজস্ব ঢঙের পারফরম্যান্সও ছিল গানে।’ এই আয়োজনের গানগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্লাটফরমে দেশ ও দেশের বাইরের দর্শক-শ্রোতারা করছেন প্রশংসা।

‘কোক স্টুডিও’ সংগীতপ্রেমীদের কাছে প্রিয় এক নাম। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে কোক স্টুডিও যাত্রা করে। ক্ল্যাসিক্যাল, লোকসংগীত, কাওয়ালি, গজল থেকে শুরু করে পপ ও রক ধারার সংগীত ফিউশনরূপে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করে কোক। পরবর্তী সময় ভারতেও বিস্তৃত হয় কোকের পরিধি। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম মৌসুম শুরু হয়। জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণব এ সংগীত আয়োজনের প্রধান কারিগর। এখন পর্যন্ত আটটি গান প্রকাশিত হয়েছে অফিশিয়াল ইউটিউব ও ফেসবুক পেজ থেকে। প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও জুটেছে কোকের গানগুলো নিয়ে। অনেকের মতেই আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে লোকজ গান পরিবেশন করলে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে লোকজ গানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নতুনত্বকে পছন্দ করছেন। তাদের মতে, গানগুলো নতুন ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গাওয়ার ফলে তারা তা শুনতে আগ্রহী হন পাশাপাশি ঐতিহ্যময় সংগীতের সঙ্গে তাদের পরিচিতিও ঘটে। এ আয়োজনটির উদ্বোধন করা হয় ‘একলা চলো রে’ গানটি দিয়ে যেখানে মমতাজ, কণা, মিজান, অর্ণব, বাপ্পা মজুমদার, সামিনা চৌধুরী, মাশা ইসলাম, অনিমেষ রায়সহ অনেককে অংশ নিতে দেখা যায়। কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম গান অনিমেষ রায়ের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘নাসেক নাসেক’ গানটি। আর তার সঙ্গে ছিল পান্থ কানাইয়ের ‘দোল দোল দুলুনি’, যেটি কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল লতিফের লেখা। গানটি নেটদুনিয়ায় ব্যাপক মাতাচ্ছে। হাজং ভাষার এই গানটি গেয়ে মাত করেছেন অনিমেষও। তিনি নিজেও হাজং সম্প্রদায়ের। অনিমেষ বলেন, ‘অর্ণবদা যখন জানতে পারলেন আমি হাজং তখন তিনিই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের ভাষায় কোনো গান জানি কি না? আমি বললাম, আমি তো নিজেই আমাদের ভাষায় গান লিখি ও গাই। তখন তিনি বেশ কয়েকটা গান শুনে এটা সিলেক্ট করলেন। বাকিটা তো সবাই দেখলেনই।’

এ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে কোক স্টুডিও বাংলার আটটি গান- অনিমেষ ও পান্থ কানাইয়ের ‘নাসেক নাসেক’, মমতাজ-মিজানের ‘প্রার্থনা’, ঋতুরাজ-নন্দিনীর ‘বুলবুলি’, নিগার সুমি-জালালী সেটের ‘ভবের পাগল’, অর্ণব-বগা রিপনের ‘চিলতে রোদ’, দলীয় ‘ভিন্নতার উৎসব’, কানিজ খন্দকার মিতু-সৌম্যদীপ মুর্শিদাবাদীর ‘সব লোকে কয়’ ও রুবায়েত-তাশফি-মাশা-সভ্যতার ‘লীলাবালি’। এরই মধ্যে অনিমেষ রায়, কানিজ খন্দকার মিতু, ঋতুরাজ, নন্দিনী আর বগা রিপনের মতো অনেক প্রতিভাবান শিল্পী ওঠে এসেছেন এ প্ল্যাটফরমের হাত ধরে। কোক স্টুডিও বাংলার গান দিয়েই নতুন করে পরিচিতি পেয়েছেন অনেকেই।

‘বুলবুলি’ গানটি নিয়ে ঋতুরাজ বলেন, ‘বিরাট কর্মযজ্ঞ। শুরুতে একটু ভয় ভয় লাগছিল। তবে অর্ণবদা পুরো গানটির প্রতিটি জায়গায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, অন্যরাও সহযোগিতা করেছেন। এটির পূর্বে মাঝে সাড়ে সাত বছর চাকরি করেছি। এখন মনে হচ্ছে ওই সময়টাও কেন সংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না! মানুষ এতদিন পরও আমাকে মনে রেখেছেন, বিষয়টি খুবই আনন্দদায়ক।’

‘সব লোকে কয় লালন কি জাত’ গেয়ে আলোচনায় আসা মিতু বলেন, ‘এত বড় প্ল্যাটফরমে লালন সাঁইজির গান করতে পেরেছি এটি আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া। এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই অর্ণবদা ও আমার ওস্তাদ গোলাম রাব্বানী রতনের প্রতি।’

এদিকে কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে জড়িত শিল্পীসহ দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল নিয়ে ৯ জুন আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয় লাইভ কনসার্ট। মূলত বিশ্বকাপ প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে কোকের এ আয়োজন ছিল।

 

এটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট

—————পার্থ বড়ুয়া

‘অনেক দিন ধরেই এমন ভিন্ন কিছুর করার জন্য চেষ্টা করছিলাম। তাও ছয়-সাত বছর ধরে হবে। এটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট। এরপর আমার স্বপ্নের উদ্যোগের কথা শেয়ার করি। সবই কাকতলীয়ভাবে হয়ে গেল তখন! এটা সত্যিই খুবই আনন্দের যে, কিছু ফোক গানকে নতুন আয়োজনে সবার সামনে তুলে ধরতে পারছি। ফোক নিয়ে যদিও এর আগে অনেক কাজ হয়েছে। তবে বাংলা গান নিয়ে ভিন্ন কিছু করার অনেক আছে। সেই প্রয়াস থেকেই মূলত এই সুন্দর আয়োজনে যুক্ত হওয়া। আমার বিশ্বাস সবার ভালো লাগছে গানগুলো।’

 

এটি সুরের প্রশান্তিদায়ক মিশ্রণ

——————————অর্ণব

‘কোক স্টুডিও হলো সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মূর্ত প্রতীক এবং বিচিত্র সুরের প্রশান্তিদায়ক মিশ্রণ। এই প্ল্যাটফরমে সংগীত প্রযোজক হিসেবে থাকতে পারাটা আমার জন্য খুব গর্বের বিষয়। প্রথম থেকেই আয়োজনের প্রতিটি গানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন শ্রোতা-দর্শকরা। সবার ভালো লাগছে বলে আনন্দিত। প্রথম থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছি নতুন কিছু সৃষ্টির। সেটা সার্থক বলা যায়। আমার বিশ্বাস, দর্শকরা ‘কোক স্টুডিও বাংলা’র অনন্য সৃষ্টিগুলো উপভোগ করছেন। ভালোবাসা রইল গানপ্রেমী মানুষের জন্য।’

Image
0
0
0
0
0
0
0
0
0
0 Comments

Follow Us on Facebook